বাংলাদেশে সম্প্রচার হওয়া বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেলে দেশি বিজ্ঞাপন প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার।

24 January, 2018

পুত্রশোক ভুলে থাকার জন্যে আমার বাবা মামলায় যেতে চাননি ।

শোকাচ্ছন্ন পিতা পুত্রশোক ভুলে থাকার জন্যে মামলায় যেতে চাননি । খুনীর শাস্তি হলেও মৃত পুত্র যে ফিরে আসবে না, এইটা ভেবে নিজের হৃদয়কে আর ভারাক্রান্ত করতে চাননি জনৈক পিতা। এই পিতার নাম মোজাম্মেল হোসেন, বাড়ী  লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার বড়খাতা অঞ্চলের পূর্ব ফকিরপাড়া গ্রামে । মোজাম্মেল হোসেন আমার বাবা এবং তাঁর নিহত পুত্র লুৎফর রহমান আমার সহোদর বড় ভাই। আমরা নয় ভাই-বোনের মধ্যে সকলের বড় লুৎফর রহমান ১৯৬৭ খ্রীষ্টাব্দের ৪ মে তারিখে তাঁরই সহকর্মী জনৈক আব্দুল হাই’র ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মৃত্যুবরন করেন । তখন তাঁর কন্যা লায়লা আরজু মান্দ বানু লাইজুর বয়স ছিল ২ বছর এবং পুত্র সাইফুর রহমান নোবেল তখন ওর মায়ের পেটে ছিল । পেশাগত জীবনের প্রথম দিকে লুৎফর রহমান শিক্ষকতা করতেন । ছাত্রজীবন শেষ করে তিনি লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার শাখাতি উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং পরবর্তীতে ১৯৬৩ খ্রীষ্টাব্দে স্থানীয় বড়খাতা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন । তৎপরে প্রতিযোগিতামুলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দরে থানা পরিবার পরিকল্পনা অফিসার হিসাবে যোগদান করেন এবং এই পদে আসীন থাকাকালীন সময়ে তিনি নিহত হলে পুলিশ বাদী হয়ে কোতয়ালী থানায় একটি মামলা দায়ের করে ।
LUTFOR RAHMAN
এখানে আমার বাবা মোজাম্মেল হোসেনের জীবনের প্রতিকুলতাকে নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা দরকার । তিনি ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন এবং তাঁর বয়স যখন ৪ বছর তখন তাঁর পিতা আফছার উদ্দিন মারা যান, তাঁর বয়স যখন ৯ বছর তখন তাঁর মা মফিজন নেছা মারা যান, এইভাবে বাবার (মোজাম্মেল হোসেনের) বয়স ১৯ বছরে পৌছতে না পৌঁছতে এক এক করে তাঁর বড়ভাই আজগার আলী, দাদী টুল্লি বিবি,নানী উপজান নেছা সবাই দুনিয়া ছেড়ে চলে যানএই সময়ে তাঁর আপন বা কাছের মানুষ বলতে কেউ ছিল না । তাঁর জীবনে নেমে আসে কষ্ট আর বিষাদের করাল গ্রাস । জীবনের এই অধ্যায়টাকে কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হলেন তাঁর বড়পুত্র । সেই সময় পুত্রের বিয়োগে তিনি পাগলপ্রায় হয়েছিলেন।  তিনি ভুলে থাকতে চেষ্টা করতেন সকল ব্যথা-বেদনাকে। ঐ দূর্ঘটনার কথা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। কেউ মৃত পুত্রের প্রসঙ্গ টানলে তা শুনতে তিনি অনাগ্রহ দেখাতেন।  বাবা কষ্ট পাবেন ভেবে আমরা তাঁর সামনে চিরিরবন্দর......লুৎফর রহমান......নাম দুটো উচ্চারণ করতাম না ।
 
এখন আমি পাঠককে মুল ঘটনায় নিয়ে যেতে চাই। গত ০৪-০৫-১৯৬৭খ্রীষ্টাব্দে চিরিরবন্দরের তৎকালীন পরিবার পরিকল্পনা  কর্মকর্তা ও আমার বড়ভাই লুৎফর রহমান ট্রেনযোগে চিরিরবন্দর থেকে দিনাজপুর জেলা সদরে আসেন এবং রেলষ্টেশনে নেমে তিনি সরাসরি জেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিসে যান এবং কিছুক্ষন বিশ্রাম নেয়ার পরে জেলা অফিসের জিপগাড়ীতে উঠে অফিসিয়াল কার্যক্রম দেখার জন্যে রানীর বন্দরের দিকে রওয়ানা দেন । ঐ দিনই দুর্ঘটনাটি ঘটে এবং দুর্ঘটনায় গুরুতরভাবে আহত বড়ভাই লুৎফর রহমান কয়েক ঘন্টা পরে মৃত্যু মুখে পতিত হন। অতপর পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা রুজু করে, মামলা নং Kotwali P.S. case no 3 dated 3.7.1967u/s 304 A/279 P.P.C(G.R No 928/67). দীর্ঘ তিন বছর তদন্ত চালনার পরে তদন্তে উঠে আসে গত ০৪-০৫-১৯৬৭ খ্রীষ্টব্দে জীপগাড়ীটি যখন রাণীর বন্দর-ভুষির বন্দরের মাঝামাঝি এসে পৌঁছে তখন ঠিক সেই সময়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যে ড্রাইভারকে সরে দিয়ে আব্দুল হাই নিজেই গাড়ী চালানো শুরু করে এবং গাড়ীটির সামনের বাম চাকা একটি গর্তে ফেলে দিয়ে বাম সীটে আসীন লুৎফর রহমানকে দরজা খুলে লাফ দিতে সে পরামর্শ দেয়, লুৎফর রহমান লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে আব্দুল হাই গাড়ীটি পিছনে নিয়ে আবার সামনের দিকে এগিয়ে নিতে থাকে এবং মাটিতে পড়ে থাকা লুৎফর রহমানের শরীরের উপর দিয়ে গাড়ীটি চালায় এবং এতে লুৎফর রহমান আহত হলে  স্থানীয় জনতা আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান এবং তিনি হাসপাতালে শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেন । তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী আব্দুল হাইকে পুলিশ গ্রেফতার করে, ৬ মাস হাজত বাসের পরে জামিনে পেয়ে আব্দুল হাই হত্যার দায় স্বীকার করে বাবাকে একটি পত্র লিখে ও তাঁর সাথে সাক্ষাত করার ইচ্ছা ব্যক্ত করে।পুত্রহারা পাগলপ্রায় আমার বাবা মোজাম্মেল হোসেন এই চিঠিখানা গোপন করে রেখেছিলেন । মুলত পুত্র শোক ভুলে থাকার জন্যে এই চিঠিখানার কথা বাবা কাউকে বলেননি  অতঃপর ঘাতক আব্দুল হাই বৃহত্তর দিনাজপুর ও রংপুরের তৎকালীন প্রায় সকল ফ্যামিলি প্লানিং অফিসারকে সাথে নিয়ে নিহতের স্ত্রী মনজু আরা ও পিতা মোজাম্মেল হোসেনের সাথে  সাক্ষাত করে ও তাঁদের পা ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করে । অপরদিকে পুত্রশোকে আচ্ছন্ন পিতা নিজ হৃদয়কে আর ভারাক্রান্ত না করার জন্যে মামলাটি খারিজ হোক এমনটিই চেয়েছিলেন। তাই তিনি ১৯৬৯ খ্রীষ্টাব্দে দিনাজপুরের পুলিশ সুপার ও Deputy Sub-Administrator M L.HQ  বরাবরে প্রেরীত স্বহস্তে লিখিত জবাবে Caseটিকে PROCEED  না করার জন্যে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। পরবর্তীতে অ্যাডভোকেট আব্দুস সালামের উকালতিতে মামলাটি রংপুরে স্থানান্তরিত হয় এবং নিহতের পিতা ও স্ত্রীর অনুরোধে বিচারক মামলাটি খারিজ করে দেন।

শাহজাহান হোসেন লিপু
(Blog টি লেখার সময়ে 
আমাকে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহায়তা
করেছেন নিহত লুৎফর রহমানের
বিধবা পত্নী মঞ্জুআরা )

15 January, 2018

লেখাপড়ায় আমার হাতে খড়ি হয় আমার বাবার কাছে ।



১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দে দেশ স্বাধীনের পরে লেখাপড়ায় আমার হাতে খড়ি হয়। তৎসময়ে ৮ম শ্রেনীতে পড়ুয়া আমার মেজো ভাই জনাব আলী আখতার গোলাম কিবরিয়া আমাকে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে আমাদের গ্রামের একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় ‘বুড়াবাউরা এম এফ পি স্কুলে নিয়ে যান এবং স্কুলের সেকেন্ড টিচার অহির উদ্দিন স্যারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমাকে তথায় প্রথম শ্রেনীতে ভর্তি করিয়ে দেন। প্রথম শ্রেনীতে আমার ভর্তি রোল ছিল ৫৪ ।
আমার বাবা মোজাম্মেল হোসেন বড়খাতা বাজার থেকে আমার জন্যে প্রথম শ্রেনীর বাংলা বই ‘ সবুজ সাথী ১ম ভাগ’ বইটি ক্রয় করে আনেন এবং রেওয়াজ অনুযায়ী আমাদের পীর সাহেব হুজুর হযরত নুর আহাম্মদ দরবেশ সাহেবের হাত দিয়ে আমার হাতে অর্পন করান । মুলত লেখাপড়ায় আমার হাতে খড়ি হয় আমার বাবার মাধ্যমেই ।
আমার বাবার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বেশীদুর ছিল না ।তিনি ভারতের মাথাভাঙ্গা ইংরেজী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেনী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন । ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর একমাত্র অভিভাবক ও বড়ভাই আজগার আলী মৃত্যুবরন করলে সংসারের হাল ধরার জন্যে লেখাপড়ায় ইতি টেনে তাঁকে বাড়ী ( বর্তমান জেলা লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা থানা/উপজেলার অন্তর্গত পূর্বফকির পাড়া গ্রাম)’তে চলে আসতে হয় । বাবার লেখাপড়া বেশীদুর না থাকলেও আমরা সব ভাইবোন, আমাদের ভ্রাতুষ্পুত্র-ভ্রাতুষ্পুত্রী, আমাদের ভাগ্নে-ভাগ্নি সবাই এস এস সি পর্যন্ত বাবার সরাসরি তত্বাবধানে লেখাপড়া করতাম ।
উল্লেখ্য যে, মুল বাড়ীটির বহিরাঙ্গনে থাকা ভিটে জমিটি বিশাল ছিল, জমিটির তফশীলঃ জেলা-লালমনিরহাট, উপজেলা/ থানা- হাতীবান্ধার অন্তর্গত মৌজা পূর্ব ফকির পাড়ার এস এ দাগ নং ১৫৯৪/ হাল দাগ নং ২৮৯৩ এর বাটা ২৯৭৮ এ ১৪(চৌদ্দ) শতক । এই জমির পূর্ব-দক্ষিন কোনে বোগড় আমগাছ তলার নীচের ফাঁকা জায়গায় এবং একই দাগের পশ্চিম সীমানায় উত্তর-দক্ষিনে লম্বা কাছারী ঘরে বাবা আমাদেরকে পড়াতেন ।
প্রতিদিন সকাল সাড়ে নয়টা বাঁজার সঙ্গে সঙ্গে লেখাপড়া বন্ধ করে আমরা স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতাম । ঠিক সেই সময়ে ফাঁকা আসনগুলোতে গ্রামের মুরুব্বীরা এসে বসতেন, তাঁরা এভাবে নিয়মিতই আসতেন এবং ভরদুপুর পর্যন্ত বাবার সঙ্গে আড্ডা দিতেন । এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন (১) নমর উদ্দিন, Grand father of Golam Morshed Shanto, (২)  মকবুল হোসেন, Father of Rafiqul Islam Pintu, ( ৩ ) নীল মামুদ বসুনিয়া, (৪) ফজলুল হক, S/O Mofiz uddin, (৫) আব্দুল আজিজ ফুকুন্দু S/O Taje Mamud,(৬) আছের মোল্লা s/o Taje mamud, (৭) আকবর আলী প্রামানিক ওরফে আকবর চৌধুরী, (৮) সৈয়দ উদ্দিন পাইকার, (৯) বিলকান্ত বর্মন, Grand father of Promoth chandra Babu ও আরও অনেকে।  এঁদের মধ্যে ফজলুল হক ছাড়া এখন কেউ বেঁচে নেই । 



Shahjahan Hossain Lipu