শিক্ষাসফরঃ ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়, বগুড়া ।
তারিখঃ ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৭
আয়োজনেঃ মোজাম্মেল হোসেন আহমেদ উচ্চ
বিদ্যালয়,
হাতীবান্ধা, লালমনিরহাট।
------------------------------
মহাস্থানগড়ে পৌঁছেই সর্বপ্রথমে দূর্গ
প্রাচীরের দক্ষিন পূর্ব কোনে হযরত শাহ সুলতান বলখী মাহী সওয়ার( রহঃ)এঁর মাজারে উপস্থিত হই । এখানে উল্লেখ
করা প্রয়োজন, হযরত শাহ সুলতান বলখী মাহী সওয়ার (রহঃ) ১৪শ শতাব্দিতে মতান্তরে ১৩৪৩ খ্রিষ্টাব্দে আবার
কারও কারও মতে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১২২০খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে পুন্ড্রবর্ধনের
শেষ রাজা পরশুরামকে পরাজিত ও নিহত করে পুন্ড্রবর্ধন জয় করেন। মাজার জিয়ারত করার পরে আমরা মহাস্থানগড়ের প্রত্নস্থলগুলো
দেখার জন্যে দলবদ্ধভাবে হাঁটা শুরু করি এবং একে একে মানকালির কুন্ড, জিয়ৎকুন্ড, পরশুরামের প্রাসাদ, গোবিন্দ ভিটা ও মহাস্থান প্রত্নতাত্বিক
জাদুঘর পরিদর্শন করি । দূর্গের বাইরেও ৭/৮ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে অনেক
প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে যা আজও পুন্ড্রনগরীর সাক্ষ্য বহন করে ।
|
|
তারপরে বেহুলার বাসরঘর দেখার জন্যে আমরা
ভ্যানগাড়ীতে উঠে মহাস্থানগড় থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিনে গোকুল গ্রামে যাই। সেখানে
আছে বেহুলার বাসরঘর। এটি বর্তমানে একটি স্মৃতি স্তুপ । প্রত্নতত্ব বিভাগের মতে,
আনুমানিক ৭ম শতাব্দি থেকে ১২০০ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে এটি নির্মিত হয়। বেহুলার
বিয়োগান্ত ঘটনা সেন যুগের অনেক আগের কাহিনী। বেহুলার বাসর ঘর একটি অকল্পনীয়
মনুমেন্ট ।
বগুড়া জেলা শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার উত্তরে
করতোয়া নদীর ডান তীরে অবস্থিত ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়ের বিস্তীর্ণ অবকাঠামো ও
প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ সমূহ প্রাচীন বাংলার রাজধানী পুন্ড্রনগরের আড়াইহাজার বছর
পূর্বেকার গৌরবোজ্জল ইতিহাসের নীরব স্বাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে।
সমগ্র বাংলার সর্বপ্রধান ও সর্বপ্রাচীন এ
দূর্গ নগরী পর্যায়ক্রমে মাটি ও ইটের বেষ্টনী দ্বারা সুরক্ষিত, যা উত্তর দক্ষিনে
১৫২৫ মিটার লম্বা ও পূর্ব পশ্চিমে ১৩৭০ মিটার প্রশস্থ এবং চারিদিকের সমতল ভুমি হতে
৫মিটার উঁচু। বেষ্টনী প্রাচীর ছাড়াও পূর্বদিকে নদী এবং অপর তিনদিকে গভীর পরিখা
নগরীর অতিরিক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল ।
আড়াইহাজার বছর আগে মহাস্থানে গড়ে উঠা সমৃদ্ধ
নগরটির নাম ছিল পুন্ড্রনগর বা পুন্ড্রবর্ধন । খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী থেকে ১৫
শতাব্দির মধ্যে এ নগর এক সমৃদ্ধ জনপদ হিসাবে বিস্তার লাভ করে । এখানে প্রাপ্ত
ব্রাহ্মী লিপিতে পুন্ড্রনগথ (পুন্ড্রনগর) উল্লেখ থেকে অনুমান করা হয় এ নগরটি সম্ভবত
মৌর্যদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ।
সম্রাট অশোক (খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩ হতে
খ্রিষ্টপূর্ব ২৩২) মৌর্য বংশের ৩য় সম্রাট ছিলেন । উত্তর বাংলায় মৌর্য শাসন
প্রতিষ্ঠিত হয় তাঁর আমলে । উত্তর বাংলা ছিল মৌর্যদের একটি প্রদেশ এবং পুন্ড্রনগর
ছিল এ প্রদেশের রাজধানী । কয়েক শতাব্দি পর্যন্ত এ স্থান পরাক্রমশালী মৌর্য, গুপ্ত,
পাল ও সেন শাসক বর্গের প্রাদেশিক রাজধানী ও পরবর্তীকালে হিন্দু সামন্ত রাজাদের
রাজধানী ছিল। তৃতীয় খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে পঞ্চদশ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অসংখ্য
হিন্দু রাজা ও অন্যান্য ধর্মের রাজারা এখানে রাজত্ব করেন ।
এই মুহূর্তে পাঠকদের জ্ঞাতার্থে দৈনিক
ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি খবরের বিষয়বস্তু তুলে ধরা উচিত বলে মনে করি । দৈনিক
ইত্তেফাকের ঐ কপিটি সহকর্মী শ্রদ্ধেয়া মোছাঃ জুয়াইরীয়া বেগমের কাছ থেকে সংগ্রহ করি
। ২৭ মে ১৯৯০ তারিখের ঐ দৈনিকটির উপসম্পাদকীয় কলামে ‘স্থান-কাল-পাত্র’ শিরোনামে
কলামিষ্ট লুব্ধক লিখেছেন, চলতি সালের( ১৯৯০খ্রি) ২০ জানুয়ারী রাজশাহী প্রত্নতত্ব
বিভাগ মহাস্থানগড়ে পুন্ড্রবর্ধন নগরীর উত্তর পার্শ্বের বেষ্টনী প্রাচীরের পশ্চিম
অংশে খননকার্য শুরু করেন এবং ৭০জন খননকারী
অক্লান্ত পরিশ্রমে মাটি খুঁড়ে মার্চের
শেষে মুসলিম যুগের এক বিশাল তোরণ বের করেন । প্রকাশ, সম্প্রতি আবিষ্কৃত তোরণটি যে
গুপ্ত যুগের বিশেষজ্ঞরা সে সম্পর্কে
নিশ্চিত হয়েছেন । তাঁদের ধারনা একই স্থানে পালযুগেরও প্রাচীর পাওয়া গেছে । অর্থাৎ
দেখা যাচ্ছে যে মহাস্থানগড়ের মাটির নীচে চাপা পড়ে রয়েছে এ দেশের জাতীয় ইতিহাসের
তিনটি অধ্যায়—হিন্দুযুগ, বৌদ্ধযুগ এবং মুসলিম যুগ।
চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ভারতবর্ষ
ভ্রমনকালে ( ৬৩৯ খ্রিঃ—৬৪৫ খ্রিঃ) পুন্ড্র নগর পরিদর্শন করেন। প্রখ্যাত ব্রিটিশ
প্রত্নতত্ববিদ স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে মহাস্থানগড়ের
ধ্বংসাবশেষকে পুন্ড্রনগর হিসাবে সঠিকভাবে সনাক্ত করেন ।
একসময়ে মহাস্থানগড়ে ছিল প্রাচীন বাংলার
রাজধানী । যিশুখৃষ্টের জন্মের ছয়শত বছর পূর্বে এখানে সভ্য জনপদ গড়ে উঠেছিল,
প্রত্নতাত্বিকভাবে তার প্রমান মিলেছে ।
তথ্যসুত্রঃ ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট,
মহাস্থানগড়ের ইতিহাস সম্পর্কিত
বিভিন্ন পুস্তক ও বিভিন্ন পত্রিকা।
মোঃ শাহজাহান হোসেন (লিপু)
সিনিয়ার শিক্ষক
মোজাম্মেল হোসেন আহমেদ উচ্চ বিদ্যালয়
হাতীবান্ধা, লালমনিরহাট।